ছবি: সংগৃহীত |
নীলাকুরিঞ্জি— কত শুনেছি তার নাম। অতি সাধারণ, হালকা নীল রঙের ছোট ছোট ফুল। গন্ধও নেই তেমন। তবুও কেন তার এত কদর!
কারণ একটাই— সে অতি দুর্লভ। বারো বছর পর পর সে ফোটে। সেই সময় পশ্চিমঘাট পর্বতমালার নীলগিরি পর্বত আক্ষরিক অর্থেই নীল হয়ে ওঠে তার আগমনে।
২০১৮ সালেই জুলাই থেকে অক্টোবর তার ফুটবার সময়। মনটা লাফিয়ে উঠেছিল। ১২ বছর পর কে কোথায় থাকব তার ঠিক নেই। সুতরাং এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। কর্তামশাইকে রাজি করানো, প্লেনের টিকিট কাটা, হোটেল বুক— ঝপাঝপ সব করে ফেললাম।
চেন্নাই হয়ে কেরলের কোচি শহর। সেখান থেকে বাসে বা গাড়ি ভাড়া করে যেতে হবে সবুজে মোড়া পাহাড়ি শহর মুন্নারে। কিন্তু, দু’দিনের মধ্যেই মনের তুরুক নাচ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। টিভি, খবরের কাগজ সব জায়গায় খবরের শিরোনামে কেরলের বন্যা। মুন্নার যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ। কোচি বিমানবন্দরেরও একই অবস্থা।
সব বুঝি বিফলে যায়। মনখারাপের বোঝা কোথায় রাখি! তবু আশায় বাঁচে চাষা। হোটেল বুকিং ক্যানসেল করলেও ফ্লাইটের টিকিট করা হলো না সেই আশাতেই। শেষে এক বন্ধুর পরামর্শে ঠিক হলো, চেন্নাই থেকে কোদাইকানাল চলে যাব। সেখানেও নাকি নীলাকুরিঞ্জি ফোটে। তবে খুবই কম।
হোক কম। তবুও দেখতে তো পাব। সেখান থেকে মুন্নার যেতে পারলে ভাল। না হলে অন্য কোথাও চলে যাব।
সেই মতো সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহান্তে বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতা থেকে দুপুরের ফ্লাইট। বিকেল ৪.৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম চেন্নাই। সেখান থেকে বেশ সুন্দর আর আরামদায়ক নাইট সার্ভিস স্লিপার বাস। ৫২৬ কিলোমিটার পথ পেরোতে সময় নেয় ঘণ্টা দশেক।
সকাল ৬টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম মেঘকুয়াশা মাখা, সদ্য ঘুম ভাঙা, হালকা শীতের চাদর জড়ানো কোদাইকানাল শহরে। মোটামুটি পছন্দসই এক হোটেল খুঁজে, লটবহর রেখে, ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়া গেল শহর দেখতে। অবশেষে বিকেলের দিকে কোদাইকানাল বোটানিকাল গার্ডেনে দেখা মিলল সেই বিরল ফুলের। পাহাড়ের গায়ে প্রাকৃতিক ভাবে জন্মানো নয়, তবু চোখের দেখা তো হলো।
সে রাত কাটল কোদাইকানালেই। পরের দিন অনিশ্চিত যাত্রা মুন্নারের দিকে। বন্যাতে মুন্নারে যাওয়ার রাস্তাগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দু-একটি খুললেও আমাদের একটু ঘুরপথেই যেতে হয়েছিল। কোদাইকানাল থেকে বাসে ২ ঘণ্টার রাস্তা বাটলাগুন্ডু। সেখান থেকে বাসে আরও প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে গিয়ে পৌঁছলাম থানিতে। এখান থেকে জিপ ভাড়া করে মুন্নার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা।
মুন্নারে ঢুকতেই মন ভাল হয়ে গেল। গোটা শহর জুড়ে শুধু সবুজ চা বাগান। আর আছে ভেষজ উদ্ভিদের চাষ। চারিদিকে বিভিন্ন আকারের পাহাড়, কোনওটা নীল, কোনওটা সবুজ। জঙ্গল, ছোট ছোট ঝরনা, লেক দিয়ে সাজানো সুন্দরী মুন্নার।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল এক উত্তেজনা নিয়ে। যে কারণে মুন্নারে আসা, তা দেখতেই আজ যাব এরাভিকুলাম ন্যাশানাল পার্ক-এ। এই সময় পাহাড় নাকি ছেয়ে থাকে নীল ফুলে। নীল আকাশের সঙ্গে নাকি বাজি লড়ে নীলগিরি।
এই ট্রিপে প্রায় জোর করেই আসা প্রকৃতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সেপ্টেম্বর, কিন্তু এখনও বর্ষার প্রকোপ কাটেনি। ২০০০ মিটার উচ্চতার এরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্কে যখন পৌঁছলাম, মেঘ নেমে এসেছে মাথার উপর। দূরের পাহাড়গুলো আবছা, রহস্যময়। আর সব থেকে দুঃখজনক ঘটনা, অতি বৃষ্টিতে প্রায় সব ফুল ঝরে গিয়েছে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। টিম টিম করে এদিক ওদিক ছড়িয়ে কিছু নীলাকুরিঞ্জি। বাকি পাহাড় জুড়ে শুধু ছাইরঙা ফুলহীন গাছগুলো ভরে আছে। মনকে সান্ত্বনা দিলাম। যে ভয়ানক বন্যার কবল থেকে বেঁচে উঠল এই শহর, তার পর এইটুকু দেখতে পাওয়াও তো সৌভাগ্যের ব্যাপার।
এরই মধ্যে হঠাৎ পাশের পাহাড় থেকে দুড়দাড় করে নেমে এল বেশ কয়েকটি 'নীলগিরি থর'। বুনো ছাগলেরই এক প্রজাতি, দেখতে কিছুটা হরিণের মতো। এই প্রাণীগুলি নীলগিরির নিজস্ব বাসিন্দা।
ইতিমধ্যে মাথার উপর জমে থাকা মেঘগুলি ভারী হয়ে আর নিজেদের ধরে রাখতে পারল না। নামল ঝমঝমিয়ে। ভিজে চুপ্পুস হয়ে ফিরে এলাম মুন্নারে। আবার বারো বছর! আর কি পাবো দেখা?
লেখাটি সংগৃহীত