Thursday, February 7, 2019

মোবাইল ফোনের কারণে কি ক্যান্সার হতে পারে?

ছবি : সংগৃহীত

মোবাইল ফোন বা এই ধরনের তারবিহীন যোগাযোগ যন্ত্র থেকে যে তরঙ্গ বিকিরণ হয় সেটা সবারই জানা। তাই বর্তমান বিশ্বে মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতার সাথে পাল্লা দিয়ে এর রেডিয়েশন নিয়ে দুশ্চিন্তাও বাড়ছে। অনেকেই বলছেন “বেশি সময় ফোন কানে নিয়ে কথা বললে মস্তিষ্কে ক্যান্সার হতে পারে… পকেটে মোবাইল ফোন রাখলে রেডিয়েশন থেকে শারীরিক ক্ষতিসাধন হতে পারে” ইত্যাদি। কিন্তু এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা কী বলছে? এমন কোনো গবেষণা কি আছে যা দ্বারা প্রমাণ হয় মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন থেকে মানুষের ক্যান্সার হতে পারে? সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এই পোস্টে।

রেডিয়েশন! রেডিয়েশন!!
আমরা কেনই বা মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন নিয়ে এতটা দুশ্চিন্তায় আছি? এর কারণ হচ্ছে, রেডিয়েশন শব্দটার মাঝেই আমরা একধরনের ভয় পাই, যে এই অদৃশ্য শক্তির নিশ্চয়ই অনেক ক্ষমতা! বিশেষ করে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পারমাণবিক হামলায় রেডিয়েশনে মানুষের ক্ষতির কথা জানার পর থেকে রেডিয়েশন শব্দটাই আমাদের কাছে একটা নেতিবাচক অর্থ দাঁড়া করাচ্ছে।

তাহলে মোবাইল ফোনের তরঙ্গ থেকে মানুষের কি ক্যান্সার হতে পারে? সত্যি কথা বলতে গত কয়েক বছর ধরেই বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর পেতে চেষ্টা করছেন। তবে এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত সকল প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর পাওয়া এখনো যায়নি।

গবেষণা কী বলছে?
গত বছর প্রকাশিত আমেরিকান সরকারের একটি গবেষণায় কতগুলো ইঁদুরের উপর খুবই উচ্চমাত্রার সেলফোন রেডিয়েশন প্রয়োগ করা হলে দেখা যায় কিছু পুরুষ ইঁদুরের হৃদপিণ্ডে এক ধরনের টিউমার সৃষ্টি হয়েছে। কিছু পুরুষ ইঁদুরের ব্রেইনেও টিউমার ধরা পড়ে। অবশ্য, স্ত্রী জাতীয় ইঁদুরে এই সমস্যা দেখা যায়নি। এর সাাথে যোগসূত্র থাকার ব্যাপারে একটি প্রেস রিলিজও প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এনভায়রোমেন্টাল হেলথ সায়েন্সেস।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি সরকারি সংস্থা এফডিএ এ ব্যাপারে বলছে, বর্তমানের সেফটি লিমিট অনুযায়ী সেলফোন থেকে বিকিরিত রেডিওফ্রিকোয়েন্সি এনার্জি  মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বলে এফডিএ বিশ্বাস করে। যদিও এসব ব্যাপারে এখনও গবেষণা চলছে।

সেলফোনগুলো থেকে অবশ্যই পরিবেশে রেডিয়েশন হচ্ছে। কিন্তু তার মানে এই না যে এটা একটা পারমাণবিক বোমা থেকে বা এক্সরে মেশিন থেকে প্রাপ্ত রেডিয়েশনের মতো শক্তিশালী!

মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন কি ক্ষতিকর?
রেডিয়েশন বিভিন্ন রকম হতে পারে। অ্যামেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সেলফোনের রেডিয়েশন হচ্ছে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি রেডিয়েশন যা মানুষের দেহকোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে টিউমার সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এগুলোকে বলে ‘নন-আয়োনাইজিং’ রেডিয়েশন বলে, যা কোষে ডিএনএ এর রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে ক্যান্সার তৈরি করতে সক্ষম নয়। এ ধরণের আরও কিছু ‘নন-আয়োনাইজিং’ রেডিয়েশন হচ্ছে এফএম রেডিওর তরঙ্গ, মাইক্রোওয়েভ এবং দৃশ্যমান আলো।

অ্যামেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি আরও বলছে, অনেক বেশি মাত্রায় মোবাইল ফোনের তরঙ্গ যদি মানবদেহের সংস্পর্শে আসে, তাহলে এটি শরীরের কোষের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিতে পারে। সেইসাথে সাইটটি এটাও বলছে, মোবাইল ফোন থেকে বিকিরিত তরঙ্গের শক্তি এতটাই কম, যে তা মানুষের কোষের উষ্ণতা বৃদ্ধি করার জন্য যথেষ্ট না।

সবকিছুর পরেও সেলফোন রেডিয়েশনকে ক্ষতিকর মনে করার জন্য অনেক তথ্য উপাত্ত হয়ত আপনি পাবেন, যেহেতু বিজ্ঞানীরাও এখনো সম্পুর্ন পরিষ্কার নন বিষয়টি নিয়ে। শত শত গবেষণা হয়েছে, কিন্তু সরাসরি সেলফোন রেডিয়েশনকে মানুষের জন্য ক্যান্সারের কারণ বলে কেউ ১০০% প্রমাণ করতে পারেনি। তবে বিজ্ঞানীরা বরাবরই এর ঝুঁকির ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন।

দিনে দিনে নেটওয়ার্কে পরিবর্তন আসছে। ইঁদুরের ওপর পরিচালিত উপরোক্ত গবেষণা ২জি, ৩জি নেটওয়ার্কের ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে করা হয়েছে। এখন ৪জি ও ৫জি এর যুগ। তাই সময়ের সাথে মোবাইল ফোনের বিকিরণ মানবদেহে কেমন প্রভাব ফেলে সে ব্যাপারে উপসংহার টানার সময় এখনও হয়নি।

তবে যেহেতু বিজ্ঞানীরা আগাম সতর্কতা হিসেবে মোবাইল ফোনের তরঙ্গ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন, তাই আমাদের অবশ্যই যতটা সম্ভব মোবাইল ব্যবহার কমানো উচিত। সেই সাথে মোবাইল ফোন এর অতিরিক্ত ব্যবহার যেন আমাদের যান্ত্রিক না করে দেয় সেদিকে খেয়াল রাখাটাও অনেক দরকার।

‘কমে যাচ্ছে পুরুষের শুক্রাণু বিলুপ্ত হতে পারে মানুষ’

ছবি: সংগৃহীত

প্রায় দুই শত টি গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা সারা বিশ্বে পুরুষদের শরীরে যে হারে শুক্রাণুর সংখ্যা বা স্পার্ম রেট কমে যাচ্ছে, শুক্রাণু কমে যাবার সেই হার বজায় থাকলে মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। প্রায় দুই শতটি  গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা দেখেছেন, ৪০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে পুরুষদের শুক্রাণুর কাউন্ট।

উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের পুরুষদের ওপর করা হয়েছিল এসব গবেষণা। মানব প্রজন্মের সাম্প্রতিক এই তথ্য নিয়ে অবশ্য কিছু গবেষক সন্দেহও প্রকাশ করেছেন। তবে তথ্য সংগ্রহের এই গবেষণা দলের প্রধান ড: হ্যাগাই লেভিন জানাচ্ছেন, ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা নিয়ে তিনি ‘খুবই উদ্বিগ্ন’।

এই তুলনামূলক গবেষণাটি করা হয় ১৯৭৩ইং  থেকে ২০১১ইং  সাল পর্যন্ত। এই সময়কালে করা ১৮৫টি গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে এই গবেষণা কাজটি করে ড: লেভিনের দল। ডঃ লেভিন একজন ‘এপিডেমিওলজিস্ট’। রোগ বিস্তার সংক্রান্ত বিদ্যা ও এর সাথে সম্পর্কিত ওষুধের শাখা, রোগের সম্ভাব্য নিয়ন্ত্রণ এসব বিষয়ে তিনি বিশেষজ্ঞ গবেষক। বিবিসিকে ডঃ লেভিন জানান, “এভাবে স্পার্ম কাউন্ট কমতে থাকলে এক সময় মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে”। শুক্রাণু কমে যাবার সংখ্যা ‘দিনে দিনে বাড়ছে’ “আমরা যদি নিজেদের জীবনযাপনের ধরন, পরিবেশ এবং রাসায়নিক ব্যবহারে পরিবর্তন না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে তা ভেবে আমি উদ্বিগ্ন” ।

“একটা সময়ে এটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, আর তাতে মানব প্রজাতির বিলুপ্তিও হয়ে যেতে পারে” -বিবিসিকে বলেন ড: লেভিন। যেসব বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার সঙ্গে ছিলেন না তারাও এই গবেষণার মানের প্রশংসা করে বলেন, তাদের কাজ খুবই ভালো, তাদের তথ্যও ঠিক আছে। কিন্তু এখনই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না যে ‘মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে’। জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির গবেষক ড: লেভিন তাঁর অনুসন্ধানে দেখেছেন, শুক্রাণুর ঘনত্ব কমে এসেছে ৫২.৪ শতাংশ এবং শুক্রাণুর কাউন্ট কমে এসেছে ৫৯.৩ শতাংশ।

 উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে বসবাসরত পুরুষদের মধ্যে  শুক্রাণুর হার কমে যাবার এই ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং এটি দিনে দিনে আরো বাড়ছে। পূ্র্ববর্তী গবেষণা নিয়ে ‘দ্বন্দ্ব’ তবে দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া এবং আফ্রিকার পুরুষদের মধ্যে শুক্রাণু কাউন্ট বা শুক্রাণুর হার কমতে দেখা যায়নি। তবে গবেষকেরা বলছেন, এসব দেশে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি এবং একটা সময়ে এখানেও শুক্রাণু কাউন্ট কমে আসতে পারে বলে ধারণা করেছেন ড: লেভিন।

এসব গবেষণার তথ্য নিয়ে বিতর্ক আছে অনেক কারণে। এর আগে কয়েকটি গবেষণা কাজে বলা হয়েছিল উন্নত অর্থনীতির দেশে শুক্রাণু কাউন্ট কমে আসছে। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকের ধারণা এর মধ্যেও ‘বিভ্রান্তিমূলক তথ্য’ রয়েছে। এছাড়া আরো কিছু গবেষণা করা হয় কমসংখ্যক পুরুষ নিয়ে। আবার ফার্টিলিটি ক্লিনিক থেকে তথ্য নিয়ে যেসব গবেষণা করা হয় সেখানে শুক্রাণু কাউন্ট কম আসা স্বাভাবিক, কারণ মানুষ সমস্যা নিয়েই সেখানে যায়। আরেকটি বড় চিন্তার বিষয় হলো, শুক্রাণু কাউন্ট কমে আসছে এমন ফলাফল দেখতে পেলে তা জার্নালে প্রকাশিত হবার সম্ভাবনা থাকে বেশি।

এই কারণে হয়তো  শুক্রাণু হার কমে আসছে এমন একটা ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে। কিন্তু এই গবেষকেরা দাবি করছেন এরকম সব ধরনের সমস্যার বিষয়েই তারা চিন্তা করেছেন এবং গবেষণা করে যে তারা যে ফলাফল পেয়েছেন তা সত্য বলে মানছেন অনেকে। যেমন শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যালান পেসি বলছেন “এর আগে শুক্রাণু কাউন্টের বিষয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে তাতে আমি খুব একটা আশ্বস্ত হয়নি।

কিন্তু ড: লেভিন ও তার দল যে গবেষণা করেছেন এবং তারা যে প্রতিবেদন দিয়েছেন তা পূর্ববর্তী অনেক গবেষণা নিয়ে ভ্রান্তি দূর করে দেয়”। ধুমপান এবং স্থূলতা তবে অধ্যাপক পেসি বলছেন, নতুন এই গবেষণাটি অনেক ভ্রান্তি দূর করলেও ফলাফলের বিষয়টি নিয়ে সতর্কতার সাথে এগুতে হবে। “এ বিষয়টা নিয়ে তর্কের অবসান কিন্তু এখনই হচ্ছে না। এ বিষয়ে আরো অনেক কাজ করতে হবে” -বলেন অধ্যাপক পেসি।

কেন শুক্রাণু হার কমে যাচ্ছে তার সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে কীটনাশক এবং প্লাস্টিকে থাকা রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসা, ওবেসিটি বা স্থূলতা, ধুমপান, মানসিক চাপ, খাদ্যভ্যাস, এমনকি অতিরিক্ত টিভি দেখা এক্ষেত্রে ক্ষতিকর বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।। ড: লেভিন বলছেন, কেন শুক্রাণুর হার কমে যাচ্ছে সে বিষয়টি জানা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। একইসাথে এমনটা যেন না ঘটে সেই উপায়ও খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেন এই চিকিৎসক বিশেষজ্ঞ।